গৌতমীপুত্র সাতকণীর কৃতিত্ব আলোচনা করো
উত্তর: মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর যখন উত্তরভারতে বৈদেশিক আক্রমণ হয় তখন দক্ষিণভারতে বৈদেশিক আক্রমণ থেকে মুক্ত ছিল। সেই সুযোগে সাতবাহন বংশ সাম্রাজ্য স্থাপন করে। সাতবাহন বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন গৌতমীপুত্র সাতকণী। প্রথম সাতকণীর অন্তত একশো বছর পর গৌতমী পুত্র সাতকর্ণী সিংহাসনে বসেন। তার মৃত্যুর পর তার মা গৌতমী বালশ্রী নাসিক প্রশস্তি রচনা করেন। নাসিক প্রশস্তি থেকে গৌতমী পুত্র সাতকণীর কৃতিত্বের কথা জানা যায়
> (ক) রাজত্বকাল:
নাসিক প্রশস্তি হতে জানা যায় তিনি শক-ক্ষত্রপ নহপানের সমসাময়িক ছিলেন এবং তাকে যুদ্ধে পরাজিত করেছিলেন। এর ভিত্তিতে আধুনিক ঐতিহাসিকেরা। মনে করেন গৌতমীপুত্র ১০৬ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন
➤ (খ) বংশগৌরব পুনরুদ্ধার:
গৌতমী পুত্র সাতকণী ছিলেন অসাধারণ সামরিক প্রতিভার অধিকারী। তিনি সাতকাহন সাম্রাজ্য বহুদূর বিস্তৃত করে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্ররূপে গড়ে তোলেন। তিনি মহারাষ্ট্র ও তার কাছাকাছি অঞ্চলগুলিকে পুনরুদ্ধার করে সাতবাহন বংশের গৌরব ফিরিয়ে আনেন। এর জন্য নাসিক প্রশস্তিতে তাকে ‘সাওরাতন স্কুল যশঃ প্রতিষ্ঠাকর কন হয়েছে।
➤ (গ) শক বিজয় :
গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী শকরাজ। নহপান এবং সহপালি জামাতা ও সেনাপতি ঋষভদত্তকে পরাজিত করে গুজরাট, মালব, দেখাই বেরার ও উত্তর কোছন অধিকার করেন। সাতকণীর কাছে নহপানের প্রাজয়ের প্রমাণ মেলে জোগালথাম্বিতে প্রাপ্ত মুদ্রা ও নাসিক প্রশস্তি থেকে শকদের পরাজিত করার জন্য নাসিক প্রশস্তিতে তাকে ‘শক-যবন-পহ্লব-নিসূদন’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।
➤ (ঘ) দ্বিতীয় শক যুদ্ধ:
শকদের বিরুদ্ধে গৌতমীপুত্র সাতকণীর সাফল্য ছিল ক্ষণস্থায়ী। কারণ তিনি শকদের অপর একটি শাখা কদামাকদের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। টলেমির রচনা এবং জুনাগড় শিলালিপি থেকে জানা যায় যে কর্দামাক শক ক্ষত্রপ রুদ্রদামন এক যুদ্ধে সাতবাহনদের পরাজিত করে উজ্জয়িনীতে রাজধানী স্থাপন করেছিলেন।
(ঙ) বৈবাহিক সম্পর্ক:
শকদের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করে তাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবার জন্য গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী শকদের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপন করেন। তিনি নিজ পুত্র কুলময়কে রুদ্রদামনের কন্যার সঙ্গে বিয়ে দেন। অবশ্য সকল ঐতিহাসিক এ ব্যাপারে একমত নয়।
(চ) অন্যান্য রাজ্য জয়:
গৌতমীপুত্র সাতকণী নর্মদা উপত্যকা, কৃষ্ণা নদী উপত্যকা প্রভৃতি স্থান জয় করে। নাসিক প্রশস্তিতে পূর্বঘাট থেকে পশ্চিমঘাট পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলের অধিপতি বলে ধরা হয়েছে। গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী দাবি করেছেন তার সেনাবাহিনী আরবসাগর, ভারতসাগর ও বঙ্গোপসাগরের জলপান করেছে। তিনি নিজেকে ত্রিসমুদ্র ক্রয়-পীতবাহন বলে উল্লেখ করেছেন।
(ছ) রাজ্যসীমা:
নাসিক প্রশস্তি থেকে জানা গেছে গৌতমীপুত্র সাতকণীর রাজ্যসীমা ছিল বিন্ধ্যপর্বত থেকে মলয় পর্বত, পূর্বঘাট থেকে পশ্চিমঘাট পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃত।
(জ) শাসনব্যবস্থা:
গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী তার রাজ্যে এক সুদক্ষ শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ধর্মশাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী দেশের শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হত। তবে তিনি তার সঙ্গে মানবতাবাদ যুক্ত করেছিলেন। তার সময়ে রাজাই ছিলেন দেশের সর্বাধিনায়ক।
(ছ) প্রজাহিতৈষী শাসক:
গৌতমীপুত্র সাতকণী ছিলেন প্রজাহিতৈষী শাসক। তিনি প্রজাদের মঙ্গলের জন্য নিরন্তর কাজ করতেন। তিনি বিনা কারণে কর বৃদ্ধি করেননি। তিনি ক্ষত্রিযদের অহঙ্কার খর্ব করে নিম্নবর্ণের মানুষদের সামাজিক মর্যাদা প্রসন করেন।
(ঞ) অন্যান্য কৃতিত্ব:
বৌতমীপুত্র সাতকর্ণী একজন প্রজাহিতৈষী ও সুদক্ষ শাসক হবার পাশাপাশি একজন সমাজসংস্কৃতি, শিল্পসাহিত্য ও স্থাপত্য ভাস্কর্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি এক সুদক্ষ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। কৃষি ও বাণিজ্যের উন্নতি ঘটিয়ে দেশের অর্থনীতিতে সমৃদ্ধি আনেন। তিনি ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অনুরাগী হলেও অন্যান্য ধর্মের প্রতি উদার ছিলেন।
মূল্যায়ন:
গৌতমীপুত্র সাতকর্ণীর মৃত্যুর পর থেকে সাতবাহনদের কেন্দ্রীয় শক্তি দুর্বল হতে থাকে। এরপর বিভিন্ন সামন্ত রাজা স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এইভাবে সাতবাহন সাম্রাজ্যের অবলুপ্তি ঘটে।