কুষাণ সম্রাট কণিষ্কের কৃতিত্ব আলোচনা করো
উত্তর: কুষাণ বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন কনিষ্ক। বিম কদফিসের পর তিনি কুষান সাম্রাজ্যের অধিপতি হন। তবে বিম কদফিসের সঙ্গে তার কি সম্পর্ক ছিল তা জানা যায়নি।
➤ (ক) সিংহাসনারোহণ কাল:
কনিষ্কের রাজত্বকাল সম্বন্ধে ঐতিহাসিকগণের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে ৭৮ খ্রিস্টাব্দে কনিষ্ক সিংহাসনে আরোহণ করেন। এই সিংহাসনারোহন কালকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তিনি ঐ বৎসর থেকে শকাব্দ নামে এক নতুন বর্ষ গণনার প্রচলন করেন। অনেকে কিন্তু এই মত গ্রহণ না করে অন্যান্য সময়ের পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছেন।
➤ (খ) রাজ্যজয়:
রাজ্যজয়ের ব্যাপারে কনিষ্ক বিশেষ সাফল্য লাভ করেন। তার রাজত্বকালে কুষান সাম্রাজ্য বিস্তৃতির চরমসীমায় পৌঁছেছিল। চৈনিক ও তিব্বতীয় লেখকগণের রচনা থেকে জানা যায় যে অযোধ্যা ও পাটলিপুত্রের শাসকগণের সঙ্গে সংঘর্ষে তিনি জয়লাভ করেছিলেন। পশ্চিমভারতের পহ্লব রাজাও তার কাছে পরাজিত হন। শুধু ভারতবর্ষের মধ্যেই নয়, ভারতবর্ষের বাইরেও যুদ্ধযাত্রা করে কনিষ্ক যথেষ্ট সাফল্য লাভকরেন। চীন দেশের সঙ্গে যুদ্ধ করে তিনি কাশগড়, খোটান ও ইয়ারখন্দ। অধিকার করেন।
➤ (গ) রাজ্যের সীমা:
কনিষ্ক এক বিশাল সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হন। তার সাম্রাজ্যকে মোটামুটি দুটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। ভারতের বাইরে কাশগড়, খোটান ও ইয়ারখন্দ তার সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। আর ভারতের সুদূর গান্ধার ও কাশ্মীর থেকে কোঙ্কন ও বারানসী পর্যন্ত এক বিশাল অংশ তার পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হয়। বিহার ও বঙ্গদেশে তার মুদ্রা পাওয়া গেলেও ঐসব স্থান তার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল কিনা জানা যায়নি। পুরুষপুর ছিল কনিষ্কের রাজধানী।
(ঘ) বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা:
বৌদ্ধ সাহিত্য থেকে জানা যায় যে কনিষ্ক তার রাজত্বের প্রথম দিকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। বৌদ্ধধর্ম প্রচার ও প্রসারে তার আন্তরিক প্রচেষ্টার জন্য যে কোনো শ্রেষ্ঠ ভারতীয় রাজার মতোই তিনি ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন। সম্রাট অশোকের মতো তিনিও ভারতবর্ষের বাইরে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য দূত প্রেরণ করেন। কনিষ্কের পর বৌদ্ধধর্মের এরকম পরম পৃষ্ঠপোষক আর কেউ জন্মগ্রহণ করেছেন কিনা সন্দেহ। এই সমস্ত কারণের জন্য অনেকে কনিষ্ককে দ্বিতীয় অশোক বলে অভিহিত করেন।
(ঙ) চতুর্থ বৌদ্ধ সঙ্গীতি আহ্বান:
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের হীনযান ও মহাযান সম্প্রদায়ের মধ্যে মতভেদ ও অনৈক্য দূর করার জন্য কনিষ্ক চতুর্থ বৌদ্ধ সঙ্গীতি আহ্বান করেন। কাশ্মীর, জলন্ধর ও কান্দাহারে এই ধর্ম মহাসম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়। বিখ্যাত বৌদ্ধ পণ্ডিত ও দার্শনিক বসুমিত্র ও অশ্বঘোষ এই সম্মেলন পরিচালনা করেন। এখানে মহাযান ধর্মমতই স্বীকৃত হয় এবং বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্রগুলি সংস্কৃতভাষায় অনুবাদের ব্যবস্থা করা হয়।
(চ) শিল্প ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা:
কনিষ্ক শিল্প এবং সংস্কৃতিরও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। পুরুষপুরে যে বিরাট চৈত্যটি তিনি নির্মাণ করান তার শিল্পসুষমা। ছিল অপূর্ব। সে যুগের স্থাপত্য শিল্পের এটি একটি অনবদ্য নিদর্শন হয়ে আছে। পরবর্তীকালে এর শিল্প সৌন্দর্য চৈনিক ও মুসলমান পরিব্রাজকগণকে বিস্মিত করেছিল। এছাড়া বহু বৌদ্ধস্তূপ ও মঠ কনিষ্কের স্থাপত্য কর্মের অনন্য নিদর্শন হয়ে আছে।
তারই পৃষ্ঠপোষকতায় গান্ধার শিল্প উৎকর্ষের চরম সীমায় উপনীত হয়। কাশ্মীরে কনিষ্কপুর নগর এবং মথুরায় অপর একটি নগর তিনি স্থাপন করেন। তিনি গুণীর সমাদর করতেন। প্রসিদ্ধ বৌদ্ধকবি, দার্শনিক এবং বুদ্ধচরিত গ্রন্থের প্রণেতা অশ্বঘোষ, বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুন, বৌদ্ধ পণ্ডিত ও শিক্ষাগুরু পার্শ ও বসুমিত্র, রাজনীতিক মাথুর প্রভৃতি মনীষী তার সভায় সমাদৃত হয়েছিলেন। আয়ুর্বেদাচার্য চরক ছিলেন তার রাজসভার অলংকার বিশেষ।
* মূল্যায়ন:
বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর ও গুপ্তযুগের অভ্যুত্থানের আগে ভারতের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ নরপতির মর্যাদা কনিষ্কের প্রাপ্য। তবে প্রশাসক হিসেবে কনিষ্কের মূল্যায়ন করা সহজসাধ্য কাজ নয়। রাবণ তার রাজ্য শাসন পদ্ধতি সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান খুবই সীমিত। তবে অনুমান করা যেতে পারে শাসক হিসাবেও তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। নচেৎ এত বড় সাম্রাজ্য তিনি টিকিয়ে রাখতে পারতেন না।